আল-হেলাল,সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির এখনও উন্নতি হয়নি। ১৯মে বৃহস্পতিবার শহরতলীর ইব্রাহিমপুর, মইনপুর,সদরগড় এলাকাগুলোর পানি কিছুটা কমলেও একইদিন ভোরবেলা থেকে শহরের সুলতানপুর, আফতাবনগর, নবীনগরসহ পৌর এলাকার বিভিন্ন এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার শহরতলীর ইব্রাহিমপুর, মইনপুর,সদরগড় ও পৌর এলাকার তেঘরিয়া আমপাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়। সুরমা নদীর দক্ষিণ প্রান্তে সুনামগঞ্জ শহরের অবস্থান। শহরের দক্ষিণ অংশে দেখার হাওর রয়েছে। সিলেট থেকে ছাতক এবং ছাতক থেকে বন্যার পানি দেখার হাওর অতিক্রম করে আঘাত হানছে জেলা শহর সুনামগঞ্জের উপর। এতে করে পৌর এলাকার দক্ষিণ ও পূর্ব প্রান্তের গ্রামগুলো প্লাবিত হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়া বিরাজমান থাকলে রাতের মধ্যেই পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে জেলা সদরের কয়েকটি এলাকার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ রয়েছে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা। ছাতক থেকে সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন রনি ও দোয়ারাবাজার থেকে এনামুল হক মুন্না দিনভর বন্যা পরিস্থিতির খবর জানান জেলা সদরে।
ছাতকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি : ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় বানভাসি মানুষ তকিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তিনদিন ধরে না খেয়েই আছেন,তাদের খবর কেউ নেয়নি। মেম্বর–চেয়ারম্যানরা কেউ হামার খোঁজ নেয়নি।’ কথাগুলো বলেছেন উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ সৈদেরগাও ইউপির চাকলপাড়া গ্রামের মৎস্যজীবী আব্দুল মতিনের স্ত্রী।তাদের অনেকের ঘরে হাঁটুপানি। এসব এলাকার কর্মজীবী লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের হাতে কাজ নেই, ঘরে চাল নেই, পকেটে নেই টাকাও। ফলে পরিবার–পরিজন নিয়ে অনেকে দিনযাপন করছেন অর্ধাহারে–অনাহারে।
রাতে ধীরে ধীরে পানি কমলে ও সকালে থেকে মুষলধারে বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বন্যার পানি আবার ও বাড়তে থাকে। সুরমা, চেলা ও ইছামতি,পিয়াইন নদীর পানি বিভিন্ন স্থানে বিপদসীমার ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। পানির প্রবল শ্রেুাতের কারনে আতংকে রয়েছেন সুরমা নদীর তীরবর্তী পরিবার গুলো ।
জানা যায়, সরকারিভাবে বানভাসি মানুষের মাঝে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বিতরণকরা হয়নি। তীব্র খাদ্য সংকটে এসব দুর্গত মানুষের দিন কাটছে অনাহারে–অর্ধাহারে। সেই সঙ্গে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গবাদি পশুর খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। উপজেলার বেরাজপুর, তাজপুর, তকিপুর, গোবিন্দগঞ্জ, নোয়াপাড়া, আলমপুর, কৃষ্ণনগর, আনন্দনগর, বাংলাবাজার, লাকেশ্বর,বাগইন,খিদুরা,দশঘর,খাগামুড়া,কাঠালপুর, গোয়াসপুর, মর্য্যাদ,রাউলী,জহিরপুর, মন্ডলপুর, ভাতগাঁও,ঝামক,লক্ষমসুম, কালেশ্বরী, খিদ্রাকাপন, কাইতকুনা, ছৈলা, শিবনগর,বিলপাড়,মোল্লাআতা,গোবিন্দগঞ্জ মড়েল, গোবিন্দনগর,আব্দুলজব্বার,তাজপুর,উজিরপুর,রামপুর,সিকন্দরপুর,মাধবপুর,চেচান,জাতুয়াসহ ১শ`৮০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে কোমড় পানি থাকায় ক্লাস বন্ধ রাখা হচ্ছে।
এদিকে উপজেলার বন্যা দুর্গতদের জন্য ৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে শতাধিক পরিবার আশ্রয় নেন। দুর্গতদের উপজেলা প্রশাসন থেকে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
উপজেলার বানভাসি মানুষের মধ্যে ত্রাণের জন্য এখন চলছে হাহাকার। তারা ত্রাণের অপেক্ষায় আছেন। প্রতিদিন শত শত মানুষ যাত্রীবাহী নৌকা দেখলেই ত্রাণ পাওয়ার আশায় ছুটে যাচ্ছেন সেখানে। এখন পর্যন্ত বিতরণকৃত ত্রাণ চাহিদার তুলনায় কম হওয়ায় খালি হাতে ফিরতে হয়েছে অধিকাংশ বানভাসিদের। এতে বন্যাদুর্গত এলাকায় তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।এভাবেই সীমাহীন দুঃখ–কষ্টে দিন কাটছে বানভাসি মানুষের। বিভিন্ন স্থানে ত্রাণের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
সরকারিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়া কিংবা বন্যায় পানিতে আটকে পড়া মানুষ ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বলছেন তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ পাচ্ছেন না। গবাদিপশু ও গোখাদ্য নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন বন্যার্তরা। অনেকে পানিতেই সারছেন প্রাকৃতিক কাজ। ফলে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকা নতুন করে বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে, যা অনেকে বলছেন ২০০৪ সালের বন্যা অতিক্রম করেছে। যোগাযোগ সড়কের অধিকাংশই পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট দেখা দেয়।
বিশেষ করে দক্ষিন ছাতকে বিভিন্ন ইউপির এখনও বড় ধরনের বন্যা চলছে। নদীগুলোর নাব্য কমে যাওয়ায় বানের পানি নামার হার আগের তুলনায় কম রয়েছে।
ছাতক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌফিক হোসেন খান বলেন, পানি বৃদ্ধির কারণে কিছু বোরো ধান ও শাক–সবজি ক্ষেতের ক্ষতি হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছেন। বন্যার বিষয় মনিটরিং এর জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। সকালে উপজেলার ইসলামপুর ও নোয়ারাই বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। বর্তমানে ৩টি আশ্রয় কেন্দ্র চালুর পাশাপাশি আরও ৬টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
দোয়ারাবাজারে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি অব্যাহত : জেলা ও উপজেলা সদরের সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ : বাড়ছে দূর্গতি
অব্যাহত পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। ধীরগতিতে দিনের প্রথম ভাগে পানি কিছুটা কমলেও থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে বাড়ছে অসহনীয় দূর্গতি। বৃহস্পতিবার (১৯ মে) সকাল ১১টার দিকে পাহাড়ি ঢল ও বন্যার তোড়ে নিমিষেই ভেঙে পড়েছে ছাতক–সুনামগঞ্জ সড়কের দোয়ারাবাজার উপজেলাধীন দোহালিয়া ইউনিয়নের পানাইল গ্রামের পশ্চিমাংশের দীর্ঘ ব্রিজটি। একই ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর ব্রিজটিও আংশিক ধসে গেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে জেলা শহর সুনামগঞ্জের সাথে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার সড়ক যোগাযোগ। এছাড়াও অধিকাংশ গ্রামিণ রাস্তাঘাটে কোমর ও বুকসমান পানি থাকায় জেলা ও উপজেলা সদরের সাথে ৯ ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পরিবার পরিজন ও গবাদি পশুপক্ষী নিয়ে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন বগুলা, বাংলাবাজার, লক্ষীপুর, সুরমা, দোহালিয়া, নরসিংপুর ও দোয়ারা সদরসহ উপজেলার ৯ ইউনিয়নের কর্মজীবীসহ পানিবন্দি লাখো মানুষ। অথৈ পানির বুকে দাঁড়িয়ে আছে সেবাবঞ্চিত সুরমা ইউনিয়নের বৈঠাখাই কমিউনিটি ক্লিনিকটি। নিজেই সেবা পাচ্ছেনা।
পানিতে পচে গিয়ে বিনষ্ট হয়েছে বন্দেহরি, গোজাউড়া ও নাইন্দার হাওরসহ সবকটি মাঠের অধিকাংশ বোরো ফসল ও শাকসবজি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উrপাদিত মাঠের পাকা ধান ঘরে তুলতে না পারায় আহাজারি থামছেনা প্রান্তিক বর্গাচাষীসহ ভূক্তভোগী কৃষকদের। ঘরের মেঝেতে হাঁটু ও কোমরসমান পানি থাকায় উঁনুনে হাড়ি বসছেনা অনেক বানভাসি পরিবারের। ভেসে গেছে অর্ধশতাধিক পুকুরের কোটি টাকার মাছ ও মাছের পোনা। ৮০ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জলমগ্ন থাকায় বন্ধ রয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে দোয়ারাবাজার সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে বন্যাদূর্গত অসহায় ও অসচ্ছল পরিবারের মাঝে শুকনা খাবারসহ প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন সুনামগঞ্জ–৫ (ছাতক–দোয়ারাবাজার) আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। পরে বন্যাদূর্গত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন তারা। এসময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাংশু কুমার সিংহ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেওয়ান আল তানভীর আশরাফী চৌধুরী বাবু, বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ।
এদিকে দোয়ারাবাজার উপজেলাকে অচিরেই দূর্গত এলাকা ঘোষণা করে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন উপজেলার সচেতন নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাংশু কুমার সিংহ জানান, বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মোকাবলায় প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও সচেষ্ট ভূমিকা পালন করছেন। অপরদিকে কৃষকদের অরক্ষিত ধান গুদামে সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
Leave a Reply