হোসাইন মাহমুদ শাহীন,সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নে চেয়ারম্যানের পরিবারে বাপপুতের নামে দুইটি পিআইসি অনুমোদনের ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতির থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। ৩১ মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক বিজন সেন রায় সরজমিনে পরিদর্শন করে কথিত বাঁধের কাজে অনিয়মের দৃশ্য অবলোকন করেন। মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে জেলা ও উপজেলা কাবিটা স্কীম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কমিটির চোখ ফাকি দিয়ে সুকৌশলে মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে তথাকথিত বাপপুতের পিআইসি অনুমোদন করে লাভবান হয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন সেকশন অফিসার (এসও)। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করেও প্রতিকার পাননি সুরমা ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মোঃ এমরান হোসেন। ইব্রাহিমপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মরহুম আব্দুল আজিজের পুত্র মোঃ এমরান হোসেনের দায়েরকৃত অভিযোগে একই গ্রামের মরহুম মোশাররফ হোসেন ময়না মিয়ার পুত্র সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজা,চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মোঃ আফজাল হোসেন ও আফজাল হোসেন ছানার পুত্র তাজুয়ার আফজল (শিহাব) কে বিবাদী করা হয়েছে ঐ অভিযোগে।“ঘুষের বিনিময়ে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজার আপন সহোদর মোঃ আফজাল হোসেন কে সদস্য সচিব করত: ২৬নং অপ্রয়োজনীয় নতুন পিআইসি অনুমোদন এবং অভিযোগকারী এমরান হোসেনকে বাদ দিয়ে চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজার ভাই আফজাল হোসেন এর পুত্র তাজুয়ার আফজল (শিহাব) কে সদস্য সচিব করত: সুরমা ইউনিয়নের ০১ নং পিআইসি প্রকল্প গঠনপূর্বক পাউবোর বরাদ্দ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন” বিষয়ে লিখিত অভিযোগটি দায়ের করা হয়।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে দায়েরকৃত অভিযোগে প্রকাশ,২০২০-২০২১ইং অর্থ বছরে সুনামগঞ্জ পওর বিভাগ-১ এর আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতিগ্রস্থ অবকাঠামো মেরামত/সংস্কারের জন্য অনুন্নয়ন রাজস্ব খাতের কাবিটা অনুকূলে শিললুয়ার হাওর উপ-প্রকল্পের ১.৬৬৫ হতে ১.৭০৬ = ৪১.০০ মিটার ডুবন্ত বাঁধের ব্রীচ ক্লোজিং ভাঙ্গা বন্ধকরন ও বাঁধ পুনারাকৃতিকরন কাজ সম্পন্ন করার জন্য মোঃ এমরান হোসেন কে সভাপতি এবং সংরক্ষিত ১,২ ও ৩নং ওয়ার্ডের সাবেক সদস্যা বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা স্বাধীনা আক্তারকে সদস্যসচিব করে পিআইসি কমিটি অনুমোদন করত: ৩,১৭,৪৫০.১৯ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তারা যথারীতি বাঁধের কাজ শতভাগ সম্পন্ন করার পরও ১,৯৮,০১৯.৮১ টাকা বিল পাওনা রয়েছে সুনামগঞ্জ পাউবোর কাছে। তাদের বকেয়া ৫৯,৬২৬.৪৭ টাকা এখনও কর্তৃপক্ষের কাছে পাওনা রয়েছে। সে হিসেবে তাদের দেয়া পিআইসির প্রস্তাবিত কমিটিখানা অনুমোদন হওয়ার কথা। তাছাড়া বিভিন্ন এলাকায় বাঁধের কাজে এখনও সাবেক মেম্বার বা সাবেক পিআইসি কমিটির লোকজনের দ্বারাই বাঁধের কাজ হচ্ছে। কিন্তু সুরমা ইউনিয়নের বর্তমান বদমেজাজী চেয়ারম্যান, ইতিপূর্বে পরিষদের সকল সদস্যগন কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে অনাস্থাপ্রাপ্ত এবং এ পর্যন্ত পরপর ৩ বার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ থেকে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে বহিস্কৃত আমির হোসেন রেজা ব্যক্তিগত আক্রোশে আক্রোশান্বিত থেকে তাহার বর্তমান পরিষদের শপথ গ্রহনের পূর্বেই এমরান হোসেনের দেয়া পিআইসির কমিটি বাতিল করে নিজের মনগড়ামতে আপন ভাই ও ভাতিজাকে পিআইসির সদস্য সচিব করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরকারী টাকা আত্মসাৎ ও অপচয়ের লক্ষে ২টি পিআইসি গঠন করেন। গত ২৮ নভেম্বর সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর ৬ জানুয়ারি পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মেম্বারগন শপথ গ্রহন করেন। অন্যদিকে সদর উপজেলা কাবিটা স্কীম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা কমিটির সভা ১৪/১২/২০২১ইং তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ০২/১২/২০২১ইং তারিখে উক্ত কমিটির অপর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার পূর্বেই এমরান হোসেন সভাপতি হয়ে এবং সংরক্ষিত ১,২,৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যা বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা স্বাধীনা আক্তার কে সদস্যসচিব করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও আশরাফুল সিদ্দিকীর কাছে একটি পিআইসি কমিটি দাখিল করেন। নিয়মানুযায়ী তার দেয়া কমিটি অনুমোদন হওয়ার কথা। কিন্তু চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজার নির্দেশে বর্তমান মেম্বার গিয়াস উদ্দিন ও তার ভাতিজা তাজুয়ার আফজল (শিহাব) মিলে পরস্পর যোগাযোগীমূলকভাবে এমরান হোসেন ও স্বাধীনা আক্তারের স্থলে গিয়াস উদ্দিন সভাপতি ও তাজুয়ার আফজল (শিহাব) সদস্যসচিব সেজে ঘুষের বিনিময়ে পূর্বের চাইতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৩,৪৬,৭৫৭.৪৫ টাকা বরাদ্দ বেশী নিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সুরমা ইউনিয়নের ০১ নং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি অনুমোদন করিয়েছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন পাউবোর কাছে বকেয়া বিল ৫৯,৬২৬.৪৭ টাকার প্রকৃত পাওনাদার এমরান হোসেন ও বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা স্বাধীনা আক্তার। অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, সুরমা ইউনিয়নের ধোপাজান চলতি নদীর পূর্বপাড়টি উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিভিন্ন পিআইসি বাঁধের দ্বারা এবং ইব্রাহিমপুর গ্রাম হতে মইনপুর হালুয়ারঘাট ভায়া ডলুরা পর্যন্ত পাকাসড়ক দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ায় মইনপুর ও ইব্রাহিমপুর গ্রামের মধ্যবর্তী শিললুয়ার হাওরে কোন অতিরিক্ত বাঁধের প্রয়োজন নেই বা অতীতে কখনও ছিলনা। গত ৫ বছরে বর্ণিত হাওরের মধ্যে কোন পিআইসি প্রকল্প গ্রহন করা হয়নি। অথচ চেয়ারম্যানের নির্দেশে তার ভাতিজা মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে ২৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করিয়ে ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল হাই কে সভাপতি ও চেয়ারম্যানের ভাই এবং তাজুয়ার আফজল (শিহাব) এর পিতা আফজাল হোসেন কে সদস্যসচিব করে সুরমা ইউনিয়নের ২৬নং নতুন পিআইসি অনুমোদন করত: সরকারী বরাদ্দ পকেটস্থ করেছে। মইনপুর ও ইব্রাহিমপুর গ্রামবাসী কথিত পিআইসির জায়গায় কখনও কোন বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি বলে ভালভাবে অবগত রয়েছেন। এছাড়া সুরমা ইউনিয়নে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় বাঁধ অনুমোদন করায় ২০১৯-২০ অর্থ বছরে পাহাড়ী ঢলের পানিতে সুনামগঞ্জ শহরের জেলা প্রশাসকের বাসভবনসহ সারা শহর পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। এজন্য পাউবোর অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের ঘটনাকে দায়ী করা হয়েছিল। যা শহরবাসী অবগত আছেন। উল্লেখ্য যে,চেয়ারম্যানের ভাতিজা শিহাব গ্রামের গরীব মৎস্যজীবীদের নামে স্থানীয় হিললুয়া বিলের ইজারা নেয়। কথিত অপ্রয়োজনীয় বাঁধের কাজের দ্বারা সে তাদের ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর,জায়গা জমি ও জলমহালের স্বার্থ সংরক্ষণে তৎপর রয়েছে। এমতাবস্থায় ৩ বিবাদীকে দেয়া পাউবোর টাকা আদায় করাসহ অপ্রয়োজনীয় পিআইসি বাতিলক্রমে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানানো হয় লিখিত অভিযোগে। অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চেয়ে পাউবোর এসও আশরাফুল সিদ্দিকীর মুঠোফোনে কল করলে তিনি বলেন,বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সফিয়ান ও বাবু বিজন সেন রায়সহ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কমিটির লোকজনসহ জেলা ও উপজেলা কমিটির কর্মকর্তারা এই দুটি পিআইসি অনুমোদন করেছেন। অনুমোদনের একক এখতিয়ার আমার নেই। ২৬নং পিআইসি একেবারেই নতুন এবং অতীতে এখানে কোন পিআইসি হয়নি বলে স্বীকার করে তিনি বলেন,যারা পিআইসির অনুমোদন নিয়েছেন তারা কোন যুক্তিতে কার স্বার্থে এখানে পিআইসি গঠন করলেন এবং বাপপুতের পিআইসি কেন নিলেন এজন্য তারা জবাবদিহী করবেন। তিনি ঘুষ গ্রহনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন,আমি হাত পেতে কারো কাছ থেকে ঘুষ নেইনি। এবং একই ইউনিয়নে পৃথক দুটি পিআইসির সদস্যসচিব যে পিতাপুত্র তা আমি আদৌ খেয়াল করিনি। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল হুদা চপল বলেন, অপ্রয়োজনীয় পিআইসি অনুমোদন নিয়ে যেহেতু জেলা প্রশাসক ও উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে সেহেতু তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন। সাবেক ইউপি সদস্যা বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা স্বাধীনা আক্তার বলেন,পাউবোর কাছে আমাদের বকেয়া টাকা পাওনা রয়েছে। গতবারের বিল আমরা এখনও পাইনি। এসও আশরাফুল সিদ্দিকী আগাম এক লাখ টাকা ঘুষ গ্রহনের বিনিময়ে আমাদের দেয়া পিআইসি বাতিল করে নতুন লোকদেরকে দিয়ে পিআইসি অনুমোদন করেছে। সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজা তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই উল্লেখ করে বলেন,পাউবোর কাজে যেমন আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই তেমনি আমার ভাই ও ভাতিজাকে সদস্যসচিব করে জেলা ও উপজেলা কমিটি কেন পিআইসি অনুমোদন করেছে এটা তারাই জানে। অভিযোগ হলে এজন্য তারাই জবাবদিহী করবে। এখানে আমার কোন জবাবদিহীতা নেই। তবে শিললুয়ার হাওরে সকল জমিই আমাদের তালুকী সম্পত্তি। এখানে আমাদের স্বার্থ আছে। কোন মহিলাকে দিয়েতো আর আমি পিআইসির কাজ করাতে পারিনা। মহিলারা বাঁধের কাজ কিভাবে করবে। আর আমি আমার ভাই ভাতিজা যারা অন্য কারো উপর ভরসাই বা কিভাবে করি। সরজমিনে প্রকল্পের সাইনবোর্ডে গিয়ে দেখা যায়,অপ্রয়োজনীয় নতুন ২৬ নং পিআইসিতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে দায়সারাভাবে কাজ করে বরাদ্দকৃত টাকার শতকরা ৫৫ ভাগ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পিআইসির সভাপতি আব্দুল হাই মেম্বার ও সদস্যসচিব আফজাল হোসেন ছানা। প্রকল্পস্থানে সাটানো সাইনবোর্ডে আফজাল হোসেন এর নামের পরে মোবাইল ০১৩০৪-৪৩৪৬৬৪ নং ফোন নাম্বারটি লেখা দেখা যায়। উক্ত নাম্বারে কল করলে সোমবার রাত ৯টায় আফজাল হোসেন বলেন,আমিই ২৬নং পিআইসির সদস্যসচিব। আমার কাজ শতভাগ সম্পন্ন করেছি এবং ৩টা চেকে বরাদ্দকৃত টাকার ৫৫ ভাগ বিল পেয়েছি। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ইমরান শাহরীয়ার বলেন,আমরা অভিযোগকারীর অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনে সচেষ্ট আছি। সর্বশেষ খবরে আরো জানা যায়,৩১ মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক বিজন সেন রায় সরজমিনে পরিদর্শন করে কথিত বাঁধের কাজে অনিয়মের দৃশ্য অবলোকন করে আসার পর সম্প্রতি টাংগুয়ার হাওরের নজরখালী বাধে পানি প্রবেশের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে অক্ষয়নগর ও ইব্রাহিমপুর গ্রামের লোকজনকে ঝড়ো করে ৪ঠা এপ্রিল সোমবার সকাল ও রাতে দুদফায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ০১ নং পিআইসির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন ও সদস্য সচিব তাজুয়ার আফজল (শিহাব) নিজেদের পিআইসির কাজে হাত দেয়। অথচ সরকারের বরাদ্দকৃত বিলের ৫৫ ভাগ টাকা এসও আশরাফুল সিদ্দিকীর সহায়তায় অনেক আগেই অর্থাৎ বাঁধের কাজ না করেই তারা পকেটস্থ করেছে।
Leave a Reply