দেশব্যাপী তুমুল সমালোচনা ও বিভিন্ন সংগঠনের দাবির মুখে নিজ অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ালেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। বিনা টিকিটের তিন যাত্রীকে জরিমানা করায় স্ত্রী শাম্মী আক্তারের নির্দেশে ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) শফিকুল ইসলামকে বরখাস্তের ঘটনায় ‘বিব্রত’ জানিয়ে দুঃখও প্রকাশ করেছেন তিনি। রোববার দুপুরে রেলভবনে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সুজন বলেন, টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। বরখাস্তের আদেশদাতা পাকশী বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঈশ্বরদীর পাকশীতে রোববার পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হন ওই ট্রেনে দায়িত্ব পালনকারী রেল কর্মচারী, যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১৪ জন। এরমধ্যে টিটিই শফিকুল ইসলাম ও অভিযোগকারী ইমরুল কায়েস প্রান্তও ছিলেন। শফিকুল ওইদিনের ঘটনা তুলে ধরেন। জানান, ওইদিন তিনি কোনো যাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেননি। আর বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের জন্য রেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদও দেন তিনি। দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বিপরীতে প্রান্ত দাবি করেন, সাংবাদিকরাই ‘বাড়াবাড়ি করে’ এ পরিস্থিতি তৈরি করেছেন।
এদিন দুপুর ১২টায় ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনে সংবাদ সম্মেলনে রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক শাহীদুল ইসলাম টিটিই বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার সময় আরও দুদিন বাড়ানো হয়েছে। দুই কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও চলমান ঘটনা ছাড়াও পাকশী রেলওয়ের নানা সমস্যা নিয়েও তদন্ত করবে কমিটি। শাহীদুল বলেন, পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিন কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যদি শফিকুল ইসলামকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দিয়ে থাকেন তবে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে রোববার বিকালে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি এ সময় ব্যর্থতার দায় নিয়ে আবারও রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। তিনি বলেন, বরখাস্তের নির্দেশদাতা মন্ত্রীর স্ত্রী ও সেই ৩ যাত্রীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
দুপুরে রেলপথমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, টিকিট ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ সম্পূর্ণ নিষেধ। টিকিট ছাড়া যাত্রী ভ্রমণ এবং এ নিয়ে জটিলতায় যে তার আত্মীয় জড়িত তা তিনি শনিবার পর্যন্ত জানতেন না। রেলে শুধু রেলপথমন্ত্রী, রেল সচিব ও ডিজি ছাড়া অন্য কেউ বিনা টিকিটে ভ্রমণ করতে পারেন না।
তবে তিনি বলেন, ট্রেনে বিনা টিকিটে যাত্রী ভ্রমণ নতুন কিছু নয়। বিনা টিকিটে যাত্রী অহরহ ভ্রমণ করে। এজন্যই টিটিইদের কাছে জরিমানা আদায়ের রিসিট দিয়ে থাকি। বিনা টিকিটিদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়।
সুজন বলেন, যে টিটিই বরখাস্ত হয়েছেন, সেই টিটিইর বরখাস্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি যদি যথাযথ দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাহলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। তিনি বলেন, টিটিইকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছেন, আমার স্ত্রী এমনটা শোনা যাচ্ছে। তবে আমি মনে করি, আমাকে না জানিয়ে আমার স্ত্রী পাকশী বিভাগের বাণিজ্যিক কর্মকর্তাকে অভিযোগ জানিয়েছেন, তা আমার জন্য নিশ্চয়ই বিব্রতকর। তিনি এও বলেন, মাত্র ৯ মাস হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমার স্ত্রীর যদি কোনো অভিযোগ থাকে, রেলওয়ের কারোর বিরুদ্ধে, তাহলে তার উচিত ছিল সরাসরি আমাকে জানানো। তিনি আমাকে তা জানাননি, এতে আমি বিব্রত। ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে কেউ দোষী হলে নিশ্চয় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্ত্রী বলেন, টিটিইকে তড়িঘড়ি বরখাস্তের আদেশ যে কর্মকর্তা (পাকশী ডিসিও) দিয়েছেন তাকে শোকজ করা হয়েছে-অল্প সময়ের মধ্যে কেন বরখাস্ত করা হলো। কোনো যাত্রী অভিযোগ দিতেই পারেন, কিন্তু সেটি যাচাই-বাছাই না করে এমন সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছে-তার কাছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
রোববার বিকালে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার যুগান্তরকে জানান, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্যরা কাজ করছেন। তবে রিপোর্ট জমা দিতে আরও ৭-৮ দিন সময় লাগতে পারে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সাধারণ ট্রেন যাত্রীদেরও বক্তব্য নেওয়া হবে। এজন্য আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছি। সাধারণ যাত্রীদের কেউ সাক্ষ্য দিলে তা গ্রহণ করা হবে।
টিটিই শফিকুল ইসলাম বিকালে যুগান্তরকে বলেন, বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের জন্য আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমি এখনো কোনো চিঠি পাইনি। কাজে যোগদানের জন্য আবেদন করেছি। তিনি বলেন, কাজে যোগ দিলে আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। রেলওয়ের রাজস্ব আদায়ে টিটিই হিসাবে যতটুকু করা যায় ততটুকু করব ইনশাআল্লাহ।
এদিকে অভিযোগকারী ও রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আকতার মনির ভাগ্নে ইমরুল কায়েস প্রান্ত তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য দিতে এসে বাইরে সংবাদকর্মীদের দেখেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গণমাধ্যমকর্মীদের সরকারবিরোধী আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গণমাধ্যমই বাংলাদেশের একমাত্র বিরোধী দল। প্রান্ত বলেন, কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমকর্মীদের ফোনে বিভিন্ন প্রশ্নবাণে আমি, আমার পরিবার বিরক্ত ও বিব্রত। আমরা সামগ্রিক বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছিলাম, অথচ সাংবাদিকরা সামান্য একটি বিষয়কে অহেতুক টানাহ্যাঁচড়া করেছেন। সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রান্ত বলেন, আপনারা এ বিষয়টি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। আমি যা বলার তদন্ত কমিটিকে বলেছি। আপনাদের সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই।
ঘটনা সম্পর্কে প্রান্তর মা ঈশ্বরদী শহরের নুরমহল্লার অধিবাসী ইয়াসমিন আক্তার নিপা যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আক্তার তার ফুপাতো বোন। তিনি ঈদ এখানেই করেছেন। ঘটনার রাতে আমার পাশে ঘুমাচ্ছিল শাম্মী। প্রান্ত ট্রেনে উঠে আমাকে জানায় যে টিটিই তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। তখন আমি বলি তুই শাম্মীকে বল। আমি তখন শাম্মী আক্তারকে ডেকে দিই। সে পাকশী রেলের এক অফিসারকে ফোন দিয়ে বললে তিনি পদক্ষেপ নেন। এ ছাড়া তো বেশি কিছু হয়নি।
ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্য : ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বলেছি, ব্যর্থতার দায় নিয়ে রেলপথমন্ত্রী যেন পদত্যাগ করেন। আজ আবারও বলছি, সংবাদে উঠে আসছে মন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশেই টিটিই শফিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিনা টিকিটি ৩ যাত্রী মন্ত্রীর স্বজন, তাদের জবাবদিহিতা কিংবা আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। এখানে নির্দেশদাতা মন্ত্রীর স্ত্রী এবং মন্ত্রীর স্বজন বিনা টিকিটি ৩ যাত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, মন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশনায় টিটিই বরখাস্ত, বিনা টিকিটি ৩ যাত্রী এবং টিটিইর কার্যকলাপসহ সাধারণ যাত্রীদের সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে যথাযথ তদন্ত রিপোর্ট বেরিয়ে আসবে। এ অবস্থায় যদি রেলপথমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকেন, তাহলে তদন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে রেলপথমন্ত্রীর সাময়িক সময়ের জন্য হলেও পদত্যাগ করা উচিত। আমরা তার পদত্যাগ চাই।
Leave a Reply