বোমার শব্দে ঘুম ভাঙে নীলিমার। রাশিয়ার সীমান্তে পূর্ব ইউক্রেনের খারকিভ শহরে ২০ বছর ধরে বাস করছেন তিনি। পুরো নাম ডা. খালেদা নাসরিন নীলিমা। চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ালেখা করতে ইউক্রেন গিয়েছিলেন এই বাংলাদেশি। এরপর সেখানেই স্থায়ী হন। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় দুই সন্তান নিয়ে তিনি পশ্চিম ইউক্রেনে রওয়ানা হন।
ট্রেনে বসে বৃহস্পতিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে নীলিমা বলেন, ‘সকালেই বোম্বিং হয়েছে। বিমানবন্দরসহ খারকিভ শহরের সর্বত্র বোমার শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আধা ঘণ্টার মধ্যে শহরে সাইরেন বাজে। মেয়র ঘোষণা করেন, কেউ যেন প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হন।
তিনি বলেন, ‘সুপার শপে খাবারের জন্য লাইন হয়ে যায়। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করেন। পরিচিত কয়েকজন আলাপ করে আমরা একসঙ্গে ট্রেনে রওয়ানা হয়েছি। আমার হাসব্যান্ডকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারিনি। দুই সন্তানের একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আরেকজন লেখাপড়া করে। তাদের নিয়ে বের হয়েছি’।
নীলিমার স্বামী বাইরে ছিলেন। বাসায় ঢুকার সময়েই শুরু হয় বোমা। তিনি পেট্রোল আনার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হন। এক ঘণ্টার পর জানান, মাত্র দুই কিলোমিটার গিয়েছেন। এমন ভয়াবহ যানজট। টেলিফোনে বর্ণনা দিচ্ছিলেন নীলিমা। তিনি বলেন, লাইন ফুরানোর আগেই পেট্রোল পাম্পে পেট্রোল শেষ হয়ে যাচ্ছে। নীলিমা যখন দুর্ভোগের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন তার কণ্ঠে ছিল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশে তার বাড়ি ঢাকায়।
নীলিমার মতো ইউক্রেনে বসবাসরত হাজার খানেক বাংলাদেশির সবাই উৎকণ্ঠিত। তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন। ইউক্রেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ডে ঢোকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী বলেন, পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসতে বাংলাদেশের দূতাবাস ইউক্রেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। ‘দূতাবাসের পক্ষ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ করে বুধবার তিনশর মতো বাংলাদেশির সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। ইউক্রেনে থেকে বাংলাদেশিদের পোল্যান্ডে নিয়ে এসে আপাতত আশ্রয় দিতে আমরা নির্দেশ দিয়েছি। সেখানে থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
শাহরিয়ার আলম বলেন, ইউক্রেনে বসবাসরত বিদেশিদের ১৫ দিনের জন্য সাময়িক ট্রানজিট ভিসা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পোল্যান্ড। আজ বা কালকের মধ্যে পোল্যান্ড তাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে বলে আশা করছি। তারপর বাংলাদেশিরা পোল্যান্ডে ঢুকতে পারবেন। তিনি জানান, ওয়ারসতে বাংলাদেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইউক্রেনে হাজার খানেক বাংলাদেশি রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী।
ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সব সময় সংলাপ এবং কূটনীতির মাধ্যমে সংকট সমাধানের নীতিতে বিশ্বাসী। দুঃখজনকভাবে পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিয়েছে। শান্তির পথে যেসব সমস্যা রয়েছে, আলোচনার মাধ্যমে তার সুরাহা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সেই সংলাপের পথে যাওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। এই যুদ্ধ বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলবে-এই প্রশ্নে শাহরিয়ার আলম বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা : ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত আব্দুল হান্নান যিনি কর্মজীবনে মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব ছিলেন, তিনি বলেছেন, তেল ও খাদ্যের দাম বাড়লে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর সব সময়েই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এতে বিশ্ব অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব হলে বাংলাদেশও তা থেকে মুক্ত থাকবে না।
তিনি বলেন, তেলের দাম বাড়লে বিমানসহ সব ধরনের পরিবহণ খরচ বাড়ে। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও তেল ও খাদ্যের দাম বাড়ায় অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী নেতিবাচক হয়েছিল। রাশিয়া প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার তেল ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। এখন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তেল কিনতে না পারলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। বিশেষ করে কাতার থেকে ইউরোপিয়ানরা এলএনজি কিনলে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়বে। কারণ বাংলাদেশও মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল কিনে। এখন মধ্যপ্রাচ্য যদি বাংলাদেশে রপ্তানিতে কাটছাঁট করে তবে চাপের সৃষ্টি হবে।
সূত্রঃ যুগান্তর
Leave a Reply