“ঈদের দিনে পুরষ্কার পাবে যত রোজাদার
শপথ করিয়া বলছেন আল্লাহ পরোয়ারগো।।
যেজনে রাখিবে রোজা, তাহার রুহু থাকবে তাজা
পাবেনা সে কোন সাজা বলছেন পরোয়ার।
রামোষ হইতে হয় উৎপত্তি,ধ্বংস করে পাপের নাথী
রোজা হবে চিরসাথী ওরে মন আমারগো।।
মুসলমানীর ৫টি স্তম্ভ,কেউ পারতে নাকরো ভঙ্গ
সৎ মানুষের ধরো সঙ্গ থাকতে এসংসার।
সৎসঙ্গে স্বর্গবাস,অসৎসঙ্গে নরকে বাস
সমুলে হইবে বিনাশ করে দেখ বিচারগো।।
রোজার পরে ইদুল ফিতর,ঈদুল আযহা আসে তারপর
হাদিস কোরআনে খবর শুন রোজাদার।
ভেবে বলে কামাল উদ্দিন,সাইয়্যাদুল মুরছালিন
ভরসা মনে সেইদিন হবেন কর্নদারগো ”।।
শুধুমাত্র মুসলমানরাই নয় সকল জাতি ধর্ম বর্ণের মানুষই জানেন ঈদ মানে খুশী বা আনন্দ। ঈদ–উল ফিতর মানে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আল্লাহর প্রতি শোকর গুজার হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়ে বিশ্ব ভ্রাতত্বৃবোধে উজ্জীবিত হওয়া। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সাম্প্রতিক করোনা আগ্রাসনের মোকাবেলায় পবিত্র ঈদ উল ফিতর আমাদের সামনে হাজির হয়েছে অনাবিল আনন্দ ও সুখ শান্তির বার্তা নিয়ে। শুধুমাত্র নিছক ধর্মীয় অনুষ্টানই নয় ঈদুল ফিতর এখন আমাদের মরমী সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। অতীন্দ্রিয় তত্বকে সামনে রেখে যিনি স্বকীয় সূর তাল লয় ছন্দে কথা গাথা কাহিনী কাব্য বা গীত রচনা করেন তিনি মরমী কবি। আর তাদের রচিত সংগীত কর্মকেই মরমী সংস্কৃতি বলে। ভাটি অঞ্চলের আবহমান কালের সংস্কৃতি ও সুফিবাদ মডেলের মরমী সংস্কৃতি এখন এক ও অভিন্ন। ওলি আউলিয়া পীর মাশায়েখ সাধক সন্নাসীগণের ইশক প্রেম মহব্বত ও পবিত্র ধর্ম ইসলামের কালজ্বয়ী আদর্শের মাধ্যমে এ অঞ্চলে উভয় সংস্কৃতি একই মোহনায় মিলিত হয়ে সুফিবাদ ও আবহমান কালের ঐক্যবদ্ধ মরমী সংস্কৃতির মজবুত ভিত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আমাদের মরমী সংস্কৃতিতে সুখ–দুঃখ, হাসি–কান্না, আনন্দ–বেদনা, সাফল্য–ব্যর্থতা, আশা–হতাশা, প্রশান্তি–উত্তেজনা সহ জীবন ও জগতের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্র সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়েছে। এতে শুধু অধর্মের কথা নেই তবে ধর্মীয় কৃষ্টি সভ্যতা আচার ব্যবহার ইত্যাদি অনেক কিছুই এ সংস্কৃতির উৎস। মূলত একারণেই বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের সর্বশ্রেষ্ট মিলন মেলা পবিত্র ঈদুল ফিতর উৎসবও আজ মরমী সংস্কৃতির একটি প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির পাশাপাশি ধর্মের শ্বাস্বত বানী ও দৈনন্দিন অনুষ্ঠান মালার ভাল দিকগুলোকে নিয়ে ইতিবাচক ঈদ গীত রচনায় ভাটি অঞ্চলের মরমী সংস্কৃতিতে যিনি আজো কোটি হৃদয়ের সুরের মাঝে কিংবদন্তী হয়ে আছেন তিনি হচ্ছেন গানের ওস্তাদ বাউল কামাল পাশা। ভাটি অঞ্চলে যাকে মডেল ধরে এখন অনেকেই ধর্মীয় হামদনাত রচনায় এগিয়ে এসেছেন। প্রায় ৬ হাজার গান রচনা ছাড়াও সঙ্গীত জগতের সকল শাখা প্রশাখায় অবাধে বিচরন করে অসম্ভব পান্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখে দেশের মরমী সংস্কৃতির ইতিহাসকে যিনি করেছেন সমৃদ্ধ। বাউল কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন ) ১৯০১ ইং সনের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মরমী কবি মোঃ আজিম উদ্দিন তার জন্মদাতা পিতা। মায়ের নাম আমেনা খাতুন (ঠান্ডার মা)। গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে তৃতীয় মান অধ্যয়ন শেষে একই গ্রামের স্থানীয় হাইস্কুলে ভর্ত্তি হতে চাইলে বাউল পিতার ও সাধারন দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় তৎকালীন জমিদার পরিবারবর্গের দ্বারা পরিচালিত ঐ শিক্ষা প্রতিষ্টানটিতে তাকে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি। পরে দূরবর্তি রাজানগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এমই,সুনামগঞ্জ জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেটের এমসি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন তিনি। একপর্যায়ে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় হাদিস শাস্ত্রের উপর লেখাপড়া করেন। সদিচ্ছা থাকা সত্তে¡ও তিনি এমএ পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারেননি। এ হতাশার কথাটি তিনি স্বরচিত একটি আঞ্চলিক গানে প্রকাশ করে গিয়েছেন,“বলো মোদের সিলেটবাসীর কিসের ভয়/যে জায়গাতে জালাল বাবা শুইয়ে আছেন সব সময়।। আদা হলদি পিয়াজ রসুন ঐ সিলেটে সব আছে/ স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ভাই জায়গায় জায়গায় বসেছে/এ কামাল কয় দুঃখের বিষয় এম.এ পড়ার সুযোগ নয়”। তিনি ১৯২৮ সালে সিলেটে মুসলিম ছাত্র সম্মিলনী উপলক্ষ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংবর্ধনা মঞ্চে গান পরিবেশন করেন। ১৯৩৫ সালে জমিদারদের আগ্রাসন এর প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠাতা আহবায়কহিসেবে গড়ে তুলেন নানকার আন্দোলন। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আসাম পার্লামেন্টে প্রজাস্বত্ত আইন পাস হয়। সুনামগঞ্জ মহকুমা কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে ১৯৩৭ সালের আসাম প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রজাবন্ধু করুনা সিন্ধু রায় এর পক্ষে গণসংযোগ করেন। পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর উপস্থিতিতে সুনামগঞ্জ স্টেডিয়ামে কংগ্রেস প্রার্থী বাবু যতীন্দ্র নাথ ভদ্রের নির্বাচনী সভায় গান পরিবেশন করেন। সংগীতের সাধনার পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন ৪৭–এর রেফারেন্ডাম ও ৫২–র ভাষা আন্দোলনে । ৫২ সালের ২৭ ফেব্র“য়ারী দিরাই থানার রাজানগর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র জনতার সম্মিলিত অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। ৫৪–র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে দিরাই, শাল¬¬া, জামালগঞ্জ আসনে মুসলীমলীগের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ আজাদ এর বিজয়কে সুনিশ্চিত করতে বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় তিনি পরিবেশন করেন-“নৌকা বাইয়া যাওরে বাংলার জনগন/যুক্তফ্রন্টের সোনার নাও ভাসাইলাম এখন/নৌকা বাইয়া যাওরে” শীর্ষক দেশাত্ববোধক গান। ৫৪ সালের নির্বাচনে তার স্বরচিত “দেশে আইলো নতুন পানি ঘুচে গেল পেরেশানী/মাছের বাড়লো আমদানী দুঃখ নাইরে আর” শীর্ষক ৫৪ লাইনের রোমান্টিক গান পাকিস্তানের সামরিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা স্বায়ত্বশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলে।৭০–এর সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে হাওরাঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আগত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানিয়ে ৫টি নির্বাচনী জনসভায় স্বাধীনতা,গণতন্ত্র ও নৌকা প্রতীকের পক্ষে নির্বাচনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৫নং সেক্টরের অধীনস্থ টেকেরঘাট সাবসেক্টর মুক্তিফৌজের ক্যাম্পে জাগরনী গান পরিবেশন এর মধ্যে দিয়ে ছাত্র যুবকদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে যেতে। প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক হিসেবে গড়ে তুলেন সাংস্কৃতিক সংগঠন “স্বাধীন বাংলা শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ”। ১৯৭৩ইং সনে সুনামগঞ্জ ষ্টেডিয়াম মাঠে জাতির জনকের সংবর্ধনা মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন। কলকাতা গ্রামোফোন কোম্পানীর একজন গ্রামোফোন গায়ক হিসেবে স্বদেশ ছাড়াও ভারত পাকিস্তানে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল। ওস্তাদ কামাল পাশা বিরচিত “তোর কি রুপ দেখাইয়া,কি যাদু করিয়া/আমারে তোর দেওয়ানা করিলে/পাগল হইয়া বন্ধু পাগল বানাইলে” এবং “পান খাইয়া যাও ও মাঝি ভাই/ঐ ঘাটে ভিড়াইয়া তোমার নাও”শীর্ষক ভাটিয়ালী গান সর্বপ্রথম কলকাতা গ্রামোফোন রেকর্ডে পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেন উপমহাদেশের বিখ্যাত ভাটিয়ালী গানের শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী। অনুরুপভাবে “প্রেমের মরা জলে ডুবেনাগো দরদী”,“পারঘাটাতে আমায় করো পার দীনবন্ধুরে”,“চোরায় করলো ডাকাতি/ঘরে আর থইয়া গেলোনা জিনিস এক রতি”, “নদীর স্রোতে নিঝুম রাতে কে যাও তরী বাইয়া/দয়া করি প্রাণের বন্ধু আমারে যাও কইয়ারে”, ভাটিয়াল পানে কে যাও বাইয়ারে ঘাটে ভিড়াও নাও/আমি অভাগিনী দিন দুঃখীনির খবর লইয়া যাওরে”,“আমি চাইনা দুনিয়ার জমিদারী কঠিন বন্ধুরে/চাইনা দুনিয়ার জমিদারী”সহ বেশ কয়েকটি কামালগীতি রেডিও টেলিভিশনে পরিবেশন করেন শিল্পী আব্দুল আলিম। একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল শিল্পী শাহ আব্দুল করিম ও জ্ঞানসাগর উপাধিতে ভূষিত মরমী কবি দূর্বীন শাহ অগ্রজ লোকশিল্পী ছিলেন তিনি। অপ্রতিদ্বন্দ্বি গীতিকার ও সুরকার হিসেবে ১৯৬৪ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারী মহকুমা প্রশাসন ও আর্টস কাউন্সিল কর্তৃক শ্রেষ্ঠ বাউল শিল্পীর পদক লাভসহ গানের সম্রাট কামাল পাশা উপাধিতে ভূষিত হন। এলাকার নির্বাচিত সাংসদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ছাড়াও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে রাজধানীর পিজি হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসাসেবা দেন। এমনকি হাসপাতাল শয্যায় শায়িত গরীব কবিকে নিজে স্বয়ং দেখতে যান এবং তার চিকিৎসার খোজখবর পর্যন্ত নেন। এ তথ্যটিকে নিশ্চিত করে সুনামগঞ্জ–২ নির্বাচনী এলাকা দিরাই শাল্লার সাবেক এমপি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন,আমার সৌভাগ্য যে আমি জীবিত অবস্থায় কামাল কবিকে দেখতে,তার সাহায্যার্থে কিছু করতে পেরেছিলাম এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খাল খনন কর্মসুচিকে উৎসাহ যুগিয়ে তিনি অনেক গানও লিখেছিলেন। বিশেষ করে ৭৫এর পূর্ববর্তী বাকশালী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সঙ্গীত সাধনার দ্বারা ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার কথা বলার একমাত্র সাহসী সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে ভাটি অঞ্চলে তার কোন বিকল্প ছিলনা। তিনি ছিলেন একজন আস্তিকতাবাদী বাউল সাধক। সাবেক রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর সাথেও এই কবি প্রতিভার পরিচয় ছিল। প্রচার বিমুখ নিভৃতচারী এই বাউল সাধক ১৯৮৫ ইং সনের ৬ এপ্রিল মোতাবেক ১৩৯২ বাংলার ২০ বৈশাখ শুক্রবার রাত ১২ টায় নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন।
খোদাপ্রেম নবীতত্ব ছাড়াও ঈদের আনন্দ উৎসবকে নিয়ে বাউল কামাল পাশা যেসব গজল সংগীত রচনা করেছেন তা বর্তমান বিশ্বের সমসাময়িক আর কোন কবি গায়ক বা সাহিত্যিকগণ আজও পারেননি। পবিত্র শবেবরাত, সেহরী, ইফতার,তারাবিহের নামাজ, লাইলাতুল কদরসহ মাসব্যাপী ধর্মীয় ইবাদতব্রত পালন শেষে আসে ঈদুল ফিতর। কেবলমাত্র ভোগের মাধ্যমে নয় ত্যাগের মহিমায় বলিয়ান হওয়ার নামই ঈদ। এজীবন শুধু জীবন নয় মৃত্যুর পরবর্তী জীবনই আসল জীবন। তাই দুই জীবনের জন্য কিছু করতে পারাটাই চরম সার্থকতা। আর এজন্য নামাজ রোজা পালন ও ভোগের পরিবর্তে যাকাত প্রদানসহ ধর্মীয় ইবাদত বন্দেগীর কোন বিকল্প নেই। মূলত এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে হেদায়েতের পথে সকল মুসলমানকে আহবান জানিয়েছেন অগ্রজ বাউল শিল্পী দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের ঐতিহাসিক নানকার আন্দোলনের বিপ্লবী নায়ক, প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সাংস্কৃতিক সহকর্মী গণসংগীত শিল্পী গানের সম্রাট কামাল উদ্দিন ওরফে কামাল পাশা। যিনি ভাগ্যরজনী পবিত্র শবেবরাতকে স্বাগত জানিয়েছেন তার গানে। গেয়েছেন,“বৎসর ঘুরে একবার আসে শবে বরাতখানী/যারা করে এই ইবাদত ধন্য তার জীবনখানী।। নফল বন্দেগী,পড়তে পারলে পূণ্য হয়,হয় নেকীর ভাগি/সে হবে আল¬ার সোহাগী,বলে সব জ্ঞানীগুনী।। বরাত শব্দে হয়রে ছুটির দিন,হাদিসে বলেছেন আমার নবী আল–আমিন/ভূল করোনা তাই কোনদিন,যয়দিন রয় জিন্দেগানী।। শুন মোমিনগন,এই রাত্রকে কদর করে থাইকো জাগরন/কামাল মিয়ার এই নিবেদন,লাভের ভাগ কেউ ছাড়েনি ”।। অনুরুপভাবে অপর আরেকটি গানে লাইলাতুল বারাতের নফল নামাজের উপর গুরুত্বারোপ করে কবি রচনা করেছেন,
“লাইলাতুল বারাত সৃষ্টির ভাগ্যরজনী/এইরাতে রিজেক ভাটেন আল¬াহু কাদের গনী।।
পড়তে হয় নফল নামাজ,এটা ইবাদতের কাজ/আল¬াহতায়ালা থাকেন রাজ,ঘুচে যায় পেরেশানী।।
মোমিনও মুত্তাকীন যারা,এবাদত করে তারা/করেনা কাফেরেরা,মানেনা নবীর বানী।।
যারা মানে এক নিয়তে,তারা সুখী হয় জগতে/একামাল কয় ভাবতে ভাবতে,গেলরে দিনরজনী ”।।
পবিত্র মাহে রমজান এর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে এই কবি গেয়েছেন,
“শুন ভাই মুসলমান,আসিয়াছে মাহে রমজান/যে রমজান পালন করিলে এদেহের হবে কল্যাণ।।
রমজানতো উম্মতের মাস,বলিয়াছেন পাক সাই/যে রাখেনা এই রমজান,তার মতো (আর) কমবখত নাই।
রামোষ ধাতুতে রমজান ফয়দা,তেজ হয় অগ্নির সমান।। মাতাপিতার সেবা ভবে যেজনে করেনা/তার মতো দূরাচার ভবে কাউকে দেখিনা। নবীর নাম শুনামাত্র সাল্লাল্লাহু সমাধান।। এ রমজান এই ভবেতে পালন করে যে জনি/কঠিন পিপাসায় খাবে কাউসারের পানি। বাউল কামালে কয় দিনরজনী রাখতে শক্তি করো দান ”।।
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জীবনের প্রত্যেকটি দিক নিয়ে পৃথক পৃথক সঙ্গীত রচনায় অসম্ভব পান্ডিত্য দেখিয়েছেন এই বাউল কবি। লাইলাতুল কদর এবং নবীজীর মেরাজে গমণ ও ভ্রমন কাহিনী নিয়ে তার রয়েছে অজস্র গান। “আপে আল্লাহ রব জলিল পাটাইলেন জিব্রাইল/মেরাজে যাইতো রাসুলুল্লাহ ইয়া আল্লাহ \
সাতাইশা রজবে হুকুম আসিলো যবে/দিনের নবীজী যাইতা আরশ মহল্লা। শুনে জিব্রাইলের ডাক আসিলেন বোরাক/দেখিয়া অবাক হইলেন রাসুলুল্লাহ, ইয়া আল্লাহ \ দ্বীনের নবী দোজাহান পাড়ি দিতে সাত আসমান/ পেরেশান হইয়া বোরাক বিদায় যাইলা। পরে রফরফে যাইয়া সাইয়্যিদুল আম্বিয়া/কাবা কাওসানে যাইয়া দীদার পাইলা \ এশকেতে বেহাল নবী উম্মতের কাঙ্গাল/৯০ হাজার বাদ সওয়াল করিলা। ৩০ হাজার কোরআনে পাইলেন আলেমগণে/বাকী ৬০ হাজার পাইলেন ওলী আল¬াহ \ আনিলেন ধর্ম কাজ রোজা আর নামাজ/ঘরে ঘরে নবীর সমাজ গড়িতা।বলে বাউল কামাল মিয়া যতসব আউলিয়া যারা/জাতের সনে যাইয়া সবাই জাত মিশাইলা ”\ অনুরুপভাবে মেরাজ তত্ত¡ নিয়ে বাউল কামাল পাশার প্রায় দুইশত বাক্যের আরেকটি দীর্ঘ গানের কয়েকটি কথা হচ্ছে “সাইয়্যাদুল মুরছালিন খাতামান নাবিয়্যিন/এলাহী আলামিন হাবিব আল্লাহর।। ধুইয়া নাপাক করেছিলেন ছিনাচাক/জীব্রাইল আসিয়া ধুইয়া করলেন পরিষ্কার।। বলেন পরোয়ারে নূরের ফেরেস্তারে/আনিয়া দেখাও হে হাবিব আমার। আতরও গোলাপও দিয়া দুনিয়াটা ভরাও গিয়া/ মোকামে মোকামে সব থাকো হুশিয়ার।। বলেন পাক সোবাহান বেহেস্তের রেজোয়ান/বেহেস্তেরে সাজাইয়া রাখো চমৎকার। হুরে গোলেমান যারা সাজিয়া থাকিতা তারা/আসিতা দরবারে প্রানবন্ধু আমার ”।।
মৃত্যুভয় জাগানোর মধ্য দিয়ে রসুল (সাঃ) এর দেখানো সরল পথে আলোকিত জীবন অনুসরনের জন্য তিনি গেয়েছেন, “কবরেতে কবরেতে শুয়াইবে গহীন জঙ্গলে গো বুঝিবে মরিলে/ভাবনা তোমার নাই গো চিন্তা তোমার নাই গো বুঝিবে মরিলে।। নামাজ রোজা ছাইরা দিয়া মদ গাজা খাইলে/নামাজ রোজা সঙ্গের সাথী কি ধন দিবে চাহিলেগো।। যারে লইয়া রঙ্গ রসে এক বিছানায় শুইলে/দূরেতে সরিয়া যাইবে দুই চক্ষু মুজিলেগো।। সু–পথও ছাড়িয়া কেন কুপথে ঘুরাইলে/আসবে সমন করবে গমন আজরাইল আসিলেগো।। কবি কামাল বলেন ঠেকবে ফুলসিরাতের পুলে/কাটিয়া কাটিয়া পড়বে দুজখের অনলে গো।।” কামাল উদ্দিন একজন রোমান্টিক কবি। বিষয়বস্তুকে সরাসরি দিক নির্দেশিত না করে রূপক অর্থে ব্যবহার করে তিনি তার গান ও কবিতায় আসল সত্যকে তুলে ধরেছেন। ঈদ আসে ঈদ যায় রংঙ্গেরই দুনিয়ায় মানুষকে চেনা বড় দায়। ঈদ শুধু শুধু ধনকুবেরদের জন্য নয় বরং ধনী গরিব সকলের জন্য। তাই যারা বিত্তবান তাদের ধন সম্পদের উপর অধিকার রয়েছে রিক্ত নিঃস্ব সর্বহারা দরিদ্র মানুষদের। ধনীরা আজীবন ধনী থাকেন না। ধন দৌলত কারও স্থায়ী সম্পদ নয়। প্রকৃত হকদারদের মধ্যে এই আমানত বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করার মধ্যে ঈদের তাৎপর্য নিহিত। তাইতো ঈদ উৎসবে আনন্দের প্রত্যাশি ভালবাসার কাংঙ্গাল ভাবুক কবি কামাল পাশার ইতিবাচক কণ্ঠে ধ্বনীত হয়, “ঈদ আনন্দে সাজও বন্ধু রঙ্গিয়ারে বন্ধু তুই বড় কঠিন/আজ কেন আমারে বাস বিন।। ওবন্ধুরে কার্ত্তিক মাসেতে ধানে ধরে খাটি রং/সন্তানের ভার মাথায় লইয়া অগ্রহায়নে মরন। কুল যুবতীর এমনি রীতি রূপ থাকে তার কয়েক দিন। ও বন্ধুরে নিহরের পানি পড়ে বাঁশে ছাড়ে পাতা/আপন মনে নির্জরেতে সর্পে লয়রে ঘাথা। তুমি যেমনি চালাও তেমনি চলি দূঃখ কষ্টে যায় মোর দিন।। ও বন্ধুরে বারিষার আগমনে ব্যাঙ্গের কত রং/আপন মনে মুর্ছাঘাতে করে কত ঢং। আষাঢ়ে শান্তির ভবে জলছাড়া হইয়াছে মীন।। ও বন্ধুরে সন্ধ্যা কালে সূর্য্য সাজে সিন্দুরের রঙ ধরে/সূর্য্যরে তেজে সাগর শোষে ঝিলমিল ঝিলমিল করে। মরন কালে দেও সাজাইয়া কান্দিয়া কয় কামাল উদ্দিন।।” ঈদ এলেই বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো সপ্তাহ ব্যাপী ভিন্ন বৈচিত্রময় অনুষ্ঠানের পসরা সাজায়। বিশেষ অনুষ্ঠানের আওতায় বছরের পর বছর এসব চলচ্চিত্র নাটক ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রত্যেক্ষ করলেও বাংঙ্গালী শ্রেুাতা দর্শকরা নতুন করে কোন বিশেষ আনন্দ উপভোগ করেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া এতে শহরের প্রিয় পরিচিত মুখগুলোই দর্শক চোখে ভেসে উঠে। অথচ স্বাধীনতা লাভের পূর্ববর্তী সময়ে ঈদ উৎসবকে সামনে রেখে গ্রামে গঞ্জে বাউল কামাল পাশার মতো স্থানীয় বাউল শিল্পীদের পরিবেশিত বাউল গান ও মালজোড়া গান শ্রেুাতা দর্শকরা গভীর আগ্রহ ভরে উপভোগ করতেন। এক গ্রামের একটি কলের গানের সেটের সামনে বসে দাড়িয়ে শত শত শ্রেুাতা দর্শকরা শুনতেন তাদের প্রিয় দেশী বাউলা গান। সে সময় “ঈদ আসিলরে বড় খুশির ঈদ/মাঠে হইবে জমাট যতসব মমিন। ও ভাই ঈদ আসিলরে\ সকালবেলা গোসল করে জামাতে সব যায়/ দুই রাকায়াত নামাযের পরে ইমামে খোৎবা শোনায়।। ঈদের নামায পড়ে সবে বুকে বুকে মিলে/ ঈদের নামায হইবে বাতিল হিংসা রাখিলে।। বাড়িতে আসিয়া সবাই কোরবানি করে। কেউ গরু কেউ ছাগল মহিষ কতজনে।। কোরবানির ঈদের অপর নাম ঈদুল আযহার/ত্যাগ–স¤প্রীতির ভালোবাসায় জীবন জাগাবার।। আল্লাহু আকবার বলে কয় লিল্লাহীল হামদ/ মুসলমানে বলা সুন্নত এ কামাল কইলাম।। ইত্যাদি কামাল সংগীতের জনপ্রিয়তা ছিল গগনচুম্বি। ইদানিং “ঈদের চাঁদ উঠিলরে রমজানের রোজার পরে/একে অন্যে ঈদ মোবারক জানায় ঘরে ঘরেরে।। ঈদ শব্দ হইল খুশি মিলে সব প্রতিবেশী/ একে অন্যেরে ভালবাসি বুকে বুক মিলন করেরে।। পড়ে সবে ঈদের নামাজ সুন্দর করে গড়ে সমাজ/তাতে নাই কোন লাজ দেখনা চিন্তা করেরে।। যারে বলে ঈদুল ফিতর কামালে কয় হাদিসে খবর/বলতেছি সবারই গোচর শুন কর্ণ ভরেরে” এসব জনপ্রিয় কামাল সংগীত গুলো আর সচরাচর শুনা যায় না। কিন্তু বিলুপ্ত হওয়া এই বাউল গানগুলোই গরীব মানুষের পক্ষে শ্রষ্টা ও বিত্তবানদের কাছে প্রানের আবেদন প্রতিষ্টিত করতো। আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটলেও বিলুপ্তির অতল গহŸরে এই ইতিবাচক সম্প্রীতির গানগুলো আজ হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে বাউল কামাল পাশা বিরচিত পল্লী মায়ের ঐ গান গুলো নিঃসন্দেহে সর্বত্র প্রাণের সাড়া জাগাতে পারে। এমনকি যেকোন স¤প্রচার মাধ্যমের আহবাণ পেলে রাতের পর রাত প্রয়াত ওস্তাদ কামাল পাশার এসব মধুর সুরের গান গেয়ে দেশবাসীকে হতবাক করে দিতে পারেন বর্তমান বাংলাদেশে পালাগানের সর্বশেষ গায়ক বাউল কামাল পাশার শিষ্য জগন্নাথপুর উপজেলার বালিকান্দি গ্রামের প্রবীন লোকশিল্পী বাউল সাহেব উদ্দিন,,বাউল হুমাযূন কবির (০১৭৬৫–০১৩০৬০) ও বাউল আমজাদ হোসাইন (০১৭৬৭–৬৬৩৯৭৯) সহ আরোও অনেকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় জাতীয় স¤প্রচার মাধ্যমগুলো অজোপাড়াগায়ে এসে এসব প্রতিভাবান বাউল শিল্পীদের কোন খবরই নেয়না। পরিশেষে আমার সবিনয় নিবেদন একদিন বা দু’দিনের জন্য নয় অথবা কেবলমাত্র ঈদ পূণর্মিলনী অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ঈদ উৎসবের আনন্দকে আমরা যেন সারা জীবনের জন্য ধরে রাখি। অডিও ভিডিও সিডি তথা আকাশ সংস্কৃতিতে যাদের স্বরচিত গীত শুনে ও দেখে আনন্দ উপভোগ করি তাদের সম্পর্কে যেন জানতে এবং কিছু করার চেষ্টা করি। কারণ বাংলার লোক সংস্কৃতির কত অমূল্য সম্পদ কালের গর্ভে আজ বিলীন হয়ে গেছে। এই অবক্ষয়ের মাঝে কামালগীতি সহ সকল প্রয়াত সংগীত স্রষ্ট্রাদের লোক সংস্কৃতিকে ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থেই সংরক্ষন করতে হবে। এজন্য সাংবাদিক ও সংস্কৃতানুরাগীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য্য। মরমী সংস্কৃতির প্রচার প্রসার ও অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপনের মধ্যে দিয়ে বাঙ্গালী জাতি হিসেবে একই আনন্দে উজ্জীবিত হয়ে আমরা সকলে মিলে এক শোষণহীন সাংস্কৃতিক সমাজ কায়েম করতে পারলেই আমাদের এ প্রচেষ্টা সফল ও সার্থক হবে। পরিশেষে গানের সম্রাট বাউল কামাল পাশা বিরচিত কোটি প্রাণের সুরে মসজিদ মাদ্রাসা এমনকি ইফতার মাহফিল তথা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে পরিবেশিত একটি ইসলামী সঙ্গীত দিয়ে প্রতিবেদনের ইতি টানছি,
“সালাতো সালামগো আমার দরুদও সালামগো আমার
জিন্দা নবী মোস্তফায়।
তোমরা যদি যাওগো মদীনায়।।
মদিনা শরীফের মাঝে বেহেশতেরী বাগান আছেও
সেই বাগানে শুইয়া আছেন (২)
দ্বীনের নবী মোস্তফায়।।
মদিনারী ধুলাবালি,চোখে মাখবো সুরমাবলীও
দ্বীনের নবীর চরনধূলী (২)
মাখবো আমার সারা গায়।।
উইড়্যা যাওরে ময়না পাখি,তোর কাছে নিবেদন রাখিও
করিছনারে তুই চালাকী (২)
কইও সালাম মোস্তফায়।।
নবীর দেখা যে পেয়েছে,দোযখ তার হারাম হয়েছেও
যে দেখেছে সে মজেছে (২)
কয় কবি কামাল পাশায় ”।।
আল–হেলাল,গীতিকার সাংবাদিক গবেষক ও লোকগীতি সংগ্রাহক এবং সম্পাদক গীতিগ্রন্থ গানের সম্রাট কামাল উদ্দিন সুনামগঞ্জ মোবাইল– ০১৭১৬–২৬৩০৪৮।
Leave a Reply