দেলোয়ার জাহিদঃ শালীনতা এবং গোপনীয়তার একটি ইসলামিক ধারণা হলো হিজাব, যে হিজাবকে পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢেকে রাখা, বিশেষত মহিলাদের পোশাকে তা প্রকাশ করা হয়- ইসলামী ঐতিহ্যের মূলে রয়েছে এ হিজাব। এটি প্রায়শই একটি ব্যক্তিগত এবং সাংস্কৃতিক ধারণা, যদিও দৃঢ়ভাবে তা ধর্মীয় নয়। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য কর্ণাটকের একটি কলেজের ছাত্রী মুসকানকে হিজাব পরহিত গেরুয়া ওড়না পরা একদল তরুণের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে।
বিবিসি বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ সমালোচনায় মত্ত। ঘটনাটি অর্থাৎ হিজাব বির্তক যা সমসাময়িক বিশ্বের একটি বলাবলির কেন্দ্রবিন্দু তাকে মানবাধিকারের আলোকে আলোচনার দাবি রাখে।
ভারতে হিজাব বির্তক: কর্ণাটকে হিজাব নিষিদ্ধের প্রতিবাদে ভাইরাল মুসলিম নারী, শীর্ষক বিবিসি বাংলার ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করা নিয়ে চলছে প্রতিবাদ-পাল্টা প্রতিবাদ। আর সেখানেই ভাইরাল হন এই মুসলিম নারী শিক্ষার্থী। ভিডিওতে দেখা যায়, বোরকা পরা মেয়েটি নিজের কলেজে বাইক চালিয়ে ঢুকছে। সেখানে তাকে লক্ষ্য করে ‘জয় শ্রী রাম’ বলে স্লোগান দিচ্ছে গেরুয়া কাপড় হাতে জড়ো হওয়া কিছু যুবক।
এ সময় মেয়েটি তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে পাল্টা স্লোগান ছুঁড়ে দেন। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ মেয়েটিকে ভেতরে নিয়ে যায়। এসবের শুরুটা হয় যখন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকের সরকার সমস্ত স্কুল-কলেজের পোশাক থেকে হিজাব নিষিদ্ধ করে।
এরপর হিজাব পরা মেয়েদের ক্লাসে ঢুকতে না দিলে একটি সরকারি প্রি ইউনিভার্সিটি কলেজের সামনে ৬ তরুণী এর প্রতিবাদ শুরু করেন। ধীরে ধীরে সেই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। এরপর হিজাব নিষিদ্ধের পক্ষে পাল্টা প্রতিবাদ হিসেবে কিছু শিক্ষার্থী গেরুয়া পরে আসতে থাকেন ক্যাম্পাসে। দুই গ্রুপ মুখোমুখি হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
কর্নাটকে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব নিয়ে উত্তেজনা, কলেজ-হাইস্কুল বন্ধ পরিস্থিতি সামলাতে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। এরমধ্যে হিজাব পরা সাংবিধানিক অধিকার দাবি করে আদালতে গিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। সরকার তিন দিনের জন্য সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে (তথ্য সূত্র : বিবিসি বাংলা)।
পোশাকের অধিকার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার উপকরণে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে; এর সঙ্গে খাদ্য এবং বাসস্থানের অধিকার, অনুচ্ছেদ ১১.১ এর অধীনে স্বীকৃত রয়েছে, যা পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার অধিকারের একটি অংশ বিশেষ। এছাড়াও অনুচ্ছেদ ২৫. বর্তমান চুক্তির কোনো কিছুই ক্ষতিকর হিসাবে ব্যাখ্যা করা হবে না সম্পূর্ণ এবং অবাধে তাদের প্রাকৃতিক অধিকার উপভোগ করার এবং ব্যবহার করার সমস্ত জনগণের অন্তর্নিহিত অধিকার সম্পদ ও অর্থ-সংগ্রহের উপায়।
অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সংস্কৃতির উপর আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বর্তমান চুক্তির রাষ্ট্রপক্ষসমূহ, এর বিবেচনায় ১৯৭২ সালের সনদে ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী জাতিসংঘ, সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতি ও সমান এবং এর মধ্যে মানব পরিবারের সকল সদস্যের অবিচ্ছিন্ন অধিকার স্বাধীনতার ভিত্তি, বিশ্বে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা। বৈশ্বিক আদর্শের বিপরীতে স্থানীয় সংস্কৃতিগুলো সাঙ্গর্ষিক কিনা এ নিয়ে বিতর্ক আছে। সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা হল এ দৃষ্টিভঙ্গি যা নৈতিক বা নৈতিক ব্যবস্থা, যা সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতিতে পরিবর্তিত হয়ে থাকে, সবই সমানভাবে বৈধ এবং কোনো একটি সিস্টেম অন্য যেকোনো একটি সিস্টেম থেকে ‘উত্তম’ তা বলার অবকাশ নেই। সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা যুক্তি দেন যে মানবাধিকার পশ্চিমা দেশগুলো দ্বারা বিকশিত হয়েছিল এবং পশ্চিমা নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে তা প্রতিষ্ঠিত। তাই এগুলো অ-পশ্চিমা সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়, যাদের বিভিন্ন ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং বিকাশের স্তর বা ধারা রয়েছে। নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতা সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি বা বুঝি তা হলো যেকোনো মতামত ব্যক্তির সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়। এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নৈতিক অবস্থানকে নির্বিকল্প ‘সঠিক’ বা ‘ভুল’ হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়।
লক্ষণীয় বিষয় হলো সার্বজনীনবাদীরা যুক্তি দেন যে, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার মতো আদর্শ আমাদের সকলের। এ বিবেচনায় সাংস্কৃতিক আপেক্ষিক যুক্তির সমালোচনায় মত্ত সার্বজনীনবাদীরা, যাকে তারা সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের ন্যায্যতা বা অন্যভাবে বলতে গেলে ক্ষতিকারক সাংস্কৃতিক অনুশীলন থেকে রক্ষার প্রচেষ্টা হিসাবে মনে করে।
মানবাধিকার নিয়ে ‘সর্বজনীনতাবাদীরা’ বিশ্বাস করে যে, একই মানবাধিকার প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত, তাদের সংস্কৃতি বা পটভূমি নির্বিশেষে ‘সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদীরা’ বিশ্বাস করে যে, মানবাধিকার চর্চায় সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। পোশাক যা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যসূচক বা ধর্মীয় অনুষঙ্গ নির্দেশ করে তা বৈষম্যকে উস্কে দিতে পারে এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সুযোগকে ও অস্বীকার করতে পারে। লোকেরা যে পোশাক পরার জন্য বেছে নেয় তা একজন ব্যক্তির সম্পর্কে অনেকগুলি জিনিসকে শনাক্ত করতে পারে: ধর্মীয় অনুষঙ্গ, জাতি, জাতীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় এবং সংস্কৃতি।
এ বিষয়ে একটি উদারণ দেওয়া যাক ৯/১১-এর পরে মাথার পাগড়ি ও অবয়বের কিছু মিল থাকার কারণে আমেরিকান শিখদের ওপর বর্ণবাদী হামলা বেড়েছে, মুসলিমদের সঙ্গে শিখরা ঘৃণ্য অপরাধের শিকার হয়েছে। জাতিকেন্দ্রিকতা সম্পর্কে কোনো জটিল যুক্তিতে না গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সত্য হিসাবে ‘সর্বজনীন মানবাধিকার’ এর ধারণাকে মেনে নেওয়া যায়। শালীনতা এবং গোপনীয়তার ধারণা থেকে এসেছে হিজাব একে একটি স্বেচ্ছামূলক ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক ধারণা হিসেবে মেনে নিয়ে শিক্ষাঙ্গণসহ সর্বত্র মানবাধিকারকে সমুন্নত করা উচিত।
Leave a Reply